আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিয়মিত বাজারে যাই বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন কীভাবে নির্ধারিত হয় এই জিনিসপত্রের দাম? এই দাম নির্ধারিত হয় মুলত বাজার দর নির্ধারণের মাধ্যমে। কিন্তু এই বাজার দর কাকে বলে? আজকের পোস্টে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করবো। অতএব দেরী না করে চলুন শুরু করি।
বাজার দর কাকে বলে?
বাজার দর হলো কোন নির্দিষ্ট পন্য ক্রয় বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দাম বা প্রাইস। কোন পন্যের দাম কত হবে তা নির্ভর করে মুলত ডিমান্ড এবং সাপ্লাই এর উপর। এছাড়া আরোও বিভিন্ন বিষয়ের উপর কোন পন্যের মার্কেট প্রাইস বা বাজার দর নির্ভর করে। নিচে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আরোও পড়ুনঃ বাজার কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি?
বাজার দর কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
বাজার দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় প্রভাব ফেলে। এগুলোর কারণে কোন পন্য বা সেবার মুল্য বাড়তে বা কমতে পারে। নিচে সেগুলো দেওয়া হলো।
- চাহিদা ও সরবরাহ: বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি থাকলে এবং সরবরাহ কম থাকলে তার দাম বেশি হবে। বিপরীতভাবে যদি সরবরাহ বেশি থাকে এবং চাহিদা কম থাকে তাহলে দাম কমে যাবে।
- উৎপাদন খরচ: পণ্য উৎপাদনের জন্য যে খরচ হয় তাও বাজার দর নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। উৎপাদন খরচ বেশি হলে পণ্যের দামও বেশি হবে।
- সরকারি নীতি: সরকার কখনও কখনও নির্দিষ্ট পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে বাজার দর প্রভাবিত হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক বাজার: যদি কোনো পণ্য আমদানি করা হয় তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের দামও স্থানীয় বাজার দরকে প্রভাবিত করতে পারে।
- মৌসুম: কিছু পণ্যের দাম মৌসুম অনুসারে পরিবর্তিত হয়। যেমন শীতকালে শাকসবজির দাম বেশি থাকে।
বাজার দর কত প্রকার?
বাজার দরের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
১. পাইকারি দর
পাইকারি দর হলো পাইকারি বাজারে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দাম। সাধারণত পাইকারি দর খুচরা দরের চেয়ে কম হয় কারণ পাইকারি ক্রেতারা বড় আকারে পণ্য ক্রয় করে।
২. খুচরা দর
খুচরা দর হলো খুচরা বাজারে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দাম। খুচরা দর পাইকারি দরের চেয়ে বেশি হয় কারণ খুচরা বিক্রেতারা ছোট আকারে পণ্য বিক্রি করে এবং তাদের বিপণন ও বিতরণ খরচ বেশি থাকে।
৩. নিয়ন্ত্রিত দর
নিয়ন্ত্রিত দর হলো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ দাম। জরুরী অবস্থায় জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকার কিছু পণ্যের নিয়ন্ত্রিত দাম নির্ধারণ করে।
৪. মুক্ত বাজার দর
মুক্ত বাজার দর হলো চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যের মাধ্যমে নির্ধারিত দাম। যেখানে সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করে না সেখানে বাজার দর মুক্ত বাজার দর নামে পরিচিত।
৫. চুক্তিভিত্তিক দর
চুক্তিভিত্তিক দর ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত দাম। কিছু ক্ষেত্রে, ক্রেতা ও বিক্রেতা নির্দিষ্ট শর্তাবলী সাপেক্ষে একটি চুক্তির মাধ্যমে পণ্য বা পরিষেবার দাম নির্ধারণ করে।
৬. আন্তর্জাতিক বাজার দর
আন্তর্জাতিক বাজার দর হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা, সরবরাহ, মুদ্রা হার, পরিবহন খরচ ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজার দর নির্ধারিত হয়।
৭. স্পট দর
স্পট দর হলো বর্তমান বাজারে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দাম। স্পট দর দ্রুত পরিবর্তনশীল হতে পারে। অনলাইন ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে এই বাজার দর ব্যবহার করা হয়।
৮. ফিউচার দর
ফিউচার দর হলোভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আগে থেকে নির্ধারিত দাম। ফিউচার দর ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে কারণ ভবিষ্যতে বাজার পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারে। এটিও অনলাইন ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
বাজার দরের প্রভাব
দৈনন্দিন জীবনে বাজার দর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনেরই প্রভাবে ফেলতে পারে। ক্রেতা, বিক্রেতা, অর্থনীতি এবং সমাজের উপর বাজার দরের প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। নিচে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজার দরের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো।
- ক্রয়ক্ষমতা: বাজার দর ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। দাম বেড়ে গেলে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং তারা কম পণ্য কিনতে পারে। অন্যদিকে দাম কমে গেলে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং তারা বেশি পণ্য কিনতে পারে।
- জীবনযাত্রার মান: বাজার দর জীবনযাত্রার মানকেও প্রভাবিত করে। প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়। বিপরীতভাবে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমে গেলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
- পছন্দের পরিবর্তন: কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতারা সেই পণ্যের বিকল্প খুঁজতে পারে। অপরদিকে কোন পণ্যের দাম কমে গেলে ক্রেতারা সেই পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে। এর ফলে ক্রেতার পছন্দের উপর প্রভাব পড়ে।
- লাভ: বাজার দর বিক্রেতার লাভের পরিমাণকে প্রভাবিত করে। দাম বেড়ে গেলে বিক্রেতার লাভ বৃদ্ধি পায়। দাম কমে গেলে বিক্রেতার লাভ হ্রাস পায়।
- উৎপাদন: বাজার দর বিক্রেতাদের উৎপাদনের পরিমানকেও প্রভাবিত করে। কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে বিক্রেতারা সেই পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। অপরদিকে কোন পণ্যের দাম কমে গেলে বিক্রেতারা সেই পণ্যের উৎপাদন হ্রাস করতে পারে।
- মুদ্রাস্ফীতি: বাজার দর মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যখন চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সরবরাহ স্থির থাকে তখন দাম বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। আবার যখন চাহিদা কমে যায় এবং সরবরাহ বৃদ্ধি পায় তখন দাম কমে যায় যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়।
- বেকারত্ব: যখন কোন পণ্যের দাম বেড়ে যায় তখন সেই পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। এর ফলে বিভিন্ন উৎপাদন প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করতে পারে এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে পারে।
- সামাজিক অস্থিরতা: বাজার দর সামাজিক অস্থিরতা জন্মের কারণ হতে পারে। যখন জনগণ মনে করে যে বাজার দর ন্যায্য নয় তখন তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে পারে। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাজার দর নিয়ে প্রায় জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর
বাজার দর নির্ধারণে কী কী বিষয় ভূমিকা রাখে?
উত্তর: চাহিদা, যোগান, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজারে প্রতিযোগিতা, সরকারি নীতি, আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বাজার দর নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
সরকার কীভাবে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করে?
উত্তর: সরকার বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন: মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকি প্রদান, কর আরোপ, আমদানি রপ্তানী নীতি নির্ধারণ ইত্যাদি।
বাজার দর কি সবসময় ন্যায্য হয়?
উত্তর: না, বাজার দর সবসময় ন্যায্য হয় না। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকলে বিক্রেতারা অন্যায্যভাবে দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
আমাদের শেষ কথা
আশাকরি বাজার দর কাকে বলে? এই বিষয়ে আপনি জানতে পেরেছেন। এছাড়া এই বিষয়ে আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।