বাজার কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত জানুন!

আমরা সাধারণত কম বেশি সবাই প্রতিদিন বাজারে যাই। সেখান থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনে বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু আপনি কি জানেন এই বাজারের ও প্রকৃত একটি অর্থ আছে?

বাজার কে আমরা পণ্য কেনা বেচার মাধ্যম হিসেবে জানলেও বাজারের বিশেষ অর্থ রয়েছে। শুধু তাই নয় বাজারের অনেকগুলো প্রকারভেদও রয়েছে। আজ এই আর্টিকেলে সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করব।

এখানে আপনি জানতে পারবেন বাজার কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি। তাই আর দেরি না করে অবশ্যই সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়তে থাকুন-

বাজার কাকে বলে?

সাধারণ অর্থে বাজার বলতে কোনো স্থানকে বুঝায়, যেখানে বিক্রেতারা একত্রিত হয়ে পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয় করে। যেমন- কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট, কাপ্তান বাজার প্রভৃতি। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি পণ্যকে কেন্দ্র করে একটি বাজার গড়ে ওঠে।

যেমন- সোনার বাজার, পাটের বাজার, ধানের বাজার প্রভৃতি। বাজারজাতকরণের দৃষ্টিতে বাজার হচ্ছে কোনো পণ্যের বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতার সমষ্টি। বর্তমান ক্রেতারা এখন পণ্য কিনছে, আর সম্ভাব্য ক্রেতারা বর্তমানে পণ্য না কিনলেও ভবিষ্যতে কিনতে পারে।

সম্ভাব্য ক্রেতাদের অভাব আছে, পণ্য ক্রয়ের মতো অর্থ আছে এবং অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা আছে। 

What are the types of markets

বাজার কত প্রকার?

অর্থনীতিতে বাজার বলতে কোনো দ্রব্যের ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট দামে ক্রয়-বিক্রয়কে বোঝায়। বাজার কত প্রকার সে সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। অর্থনীতিবিদদের মত অনুসারে বাজার তিন প্রকার। যথা-

ক. আয়তনের ভিত্তিতে বাজার,

খ. সময়ের ভিত্তিতে বাজার 

গ. প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজার।

নিম্নে এগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো-

১) আয়তনের ভিত্তিতে বাজার

আয়তনের ভিত্তিতে বাজারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. স্থানীয় বাজার (Local Market),

২. জাতীয় বাজার (National Market) 

৩. আন্তর্জাতিক বাজার (International Market)।

১. স্থানীয় বাজার (Local Market)

যদি একটি দ্রব্য বিশেষ একটি এলাকায় ক্রয়-বিক্রয় হয় অর্থাৎ একটি বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এরূপ বাজারকে স্থানীয় বাজার বলে। যেমন- শাকসবজির বাজার, মাছের বাজার, দুধের বাজার ইত্যাদি।

২. জাতীয় বাজার (National Market)

যেখানে একটি দ্রব্য দেশব্যাপী ক্রয়-বিক্রয় হয়; কিন্তু বিদেশে রপ্তানি করা হয় না। অর্থাৎ দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এরূপ বাজারকে জাতীয় বাজার বলে। যেমন- কোনো দেশে প্রস্তুত বস্ত্র,  আসবাবপত্র, প্রসাধনী ইত্যাদির বাজার।

৩. আন্তর্জাতিক বাজার (International Market)

যদি কোনো দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রয়-বিক্রয় হয়, তবে সেসব দ্রব্যের বাজারকে আন্তর্জাতিক বাজার বলে। যেমন- বাংলাদেশের পাট, মধ্যপ্রাচ্যের তেল, স্বর্ণ ইত্যাদির বাজার।

২) সময়ের ভিত্তিতে বাজার

সময়ের ভিত্তিতে বাজারকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. অতি স্বল্পকালীন বাজার (Very Short Period Market)

২. স্বল্পকালীন বাজার (Short Period Market)

৩. দীর্ঘকালীন বাজার (Long Period Market) 

৪. ও অতি দীর্ঘকালীন বাজার (Very Long Period Market)

১. অতি স্বল্পকালীন বাজার (Very Short Period Market)

অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শালের মতে, যে বাজারের স্থিতিশীলতা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন, সে বাজারকে অতি স্বল্পকালীন বাজার বলে। এ বাজারে চাহিদা সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক হয়। এরূপ বাজারে সহজে যোগান বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস করা যায় না।

এরুপ বাজারে চাহিদা দ্বারাই দাম নির্ধারিত হয়।  মাছ, দুধ,মাংস, শাকসবজি প্রভৃতির বাজারকে অতি স্বল্পকালীন বাজার বলে।

২. স্বল্পকালীন বাজার (Short Period Market)

স্বল্পকালীন বাজারের স্থায়িত্ব কয়েক মাস হতে পারে। স্বল্পকালীন বাজারে চাহিদা অনুযায়ী যোগান বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস করা যায় না। তবে এরূপ বাজারে যোগানের পরিমাণ সামান্য কিছু বৃদ্ধি অথবা হ্রাস করানো যেতে পারে।

কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদিত দ্রব্য যেমন লুঙ্গি, গামছা, চাদর ইত্যাদি স্বল্পকালীন বাজারের অন্তর্গত।

৩. দীর্ঘকালীন বাজার (Long Period Market)

দীর্ঘকালীন বাজারের পরিধি এক বছর বা কয়েক বছর হতে পারে। তাই চাহিদার বৃদ্ধি বা হ্রাসের সাথে তাল মিলিয়ে শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যের বৃদ্ধি বা হ্রাস সম্ভব হয়।

এরূপ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পেলে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যোগান বা সরবরাহ বৃদ্ধি করতে পারে। এ বাজারে চাহিদা ও যোগান উভয়ই দামের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

৪. অতি দীর্ঘকালীন বাজার (Very Long Period Market) 

অতি দীর্ঘকালীন বাজার কয়েক মাস ,কয়েক বছর বছর হতে এক যুগের বেশি সময় হতে পারে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ও নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের ফলে মানুষের উন্নত জ্ঞানের সমন্বয়ে  উন্নত রুচিমাফিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন সম্ভব হয়।

রূপ বাজার ক্রেতার রুচি, জনসংখ্যা,পছন্দ,  জ্ঞান, অভ্যাস, ইত্যাদি দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে।

৩) প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজার

প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজারকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Perfect Competition Market) 

২. অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Imperfect Competition Market) 

১. পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Perfect Competition Market)

যে বাজারে বিক্রেতার সাথে বিক্রেতার, ক্রেতার সাথে ক্রেতার এবং বিক্রেতার সাথে ক্রেতার পূর্ণমাত্রায় প্রতিযোগিতা থাকে, তাকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে।

বাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে যখন পূর্ণ প্রতিযোগিতা বিরাজ করে, তাকেই পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলা হয়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বহুসংখ্যক ক্রেতা-বিক্রেতা একই রকম দ্রব্যসামগ্রীর জন্য দরকষাকষি করে বিশেষ একটি দামে মতৈক্যে আসে।

যেকোনো বিক্রেতা ইচ্ছা করলে বাজারে প্রবেশ করতে পারবে বা ইচ্ছা করলে বাজার ত্যাগ করতে পারবে।

২. অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (Imperfect Competition Market)

যে বাজারে এক বা একাধিক কিন্তু অসংখ্য নয়, ক্রেতা ও বিক্রেতা অসম প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে, তাকে অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে। অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বিপরীত।

অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। দ্রব্যসামগ্রীর গুণাগুণও এক রকম নয়। এছাড়া বিক্রেতা বিভিন্ন ক্রেতার কাছ থেকে বিভিন্ন দাম নিতে পারে। এরূপ বাজারে প্রচুর মুনাফা অর্জন করা যায়।

অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কয়েকটি ভাগ

১) একচেটিয়া বাজার (Monopoly Market)

২) ডুয়োপলি বাজার (Duopoly Market)

৩) অলিগোপলি বাজার (Oligopoly Market)

৪) একচেটিয়ামূলক প্রতিযোগিতার বাজার (Monopolistic Competition Market)

৫) দ্বিপাক্ষিক একচেটিয়া বাজার (Bilateral Monopoly Market)

৬) মনোপসনি বাজার (Monopsony Market)

৭) ডুয়োপসনি বাজার (Duopsony Market)

৮) অলিগোপসনি বাজার (Oligopsony Market)

বিপণনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজারের প্রকারভেদ 

বিপণনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজার তিন প্রকার। যথা:-

১. ভোক্তা বাজার (Consumer Markets)

২. শিল্প বাজার (Industrial Markets)

৩. পুনঃবিক্রেতার বাজার (Reseller Markets)

১. ভোক্তা বাজার

যেসব ক্রেতা শুধুই ভোগ করার উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করে তাদের সমন্বয়ে ভোক্তা বাজারের সৃষ্টি হয়। ভোক্তা বাজারের গ্রাহকগণ কখনই ক্রীত পণ্য পুনরায় বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করার জন্য পণ্য ক্রয় করে না।

পণ্যের উপযোগ ভোগ করা কিংবা পণ্য থেকে উপকার পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তারা পণ্য ক্রয় করে।

আমরা যারা সমাজে বিচরণ করি, তারা প্রত্যেকেই বহু ধরনের ‘ভোক্তা বাজার’-এর সাথে সংযুক্ত। আমরা যে পণ্য ক্রয় করি নিজের ব্যবহারের জন্য, পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য, আমরা সেই সকল পন্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বাজারের ভোক্তা হই ‌।

সমাজের জনসংখ্যা ও মানুষের কর ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে বাজারের সংখ্যা ও আয়তন ততোই বাড়তে থাকে।

২. শিল্প-বাজার

শিল্প-বাজার বলতে এমন কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমষ্টিকে বোঝায় যারা উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য পণ্য ক্রয় করে। অর্থাৎ সোজা কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, যারা একটি নতুন দ্রব্য তৈরি করে তা বিক্রি করার জন্য অন্যের নিকট থেকে বিশেষ ধরনের কাঁচামাল বা অন্যরূপ সামগ্রী খরিদ করে, তাদেরকে নিয়েই শিল্প-বাজারের সৃষ্টি হয়।

শিল্প-বাজারে শুধু শিল্পপণ্য (industrial goods) ক্রয়-বিক্রয় হয় ভোগ্যগণ্য নয়। শিল্প-বাজারকে তাই উৎপাদকের বাজারও (producer’s market) বলা যায়।

৩. পুনঃবিক্রেতার বাজার

খুচরা ব্যবসায়ী,পাইকারি ব্যবসায়ী  ইত্যাদি মধ্যস্থকারবারিদের নিয়ে পুনঃবিক্রেতার বাজার গঠিত হয়। বস্তুতপক্ষে, যে সকল ব্যবসায়ী চূড়ান্ত পণ্য ক্রয় করার পর আবার বিক্রি করার উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে তাদেরকে সামগ্রিকভাবে ‘পুনঃবিক্রেতার বাজার’ নামে অভিহিত করা হয়।

বাজার নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের উক্তি

  • Philip Kotler এবং Gary Armstrong এর মতে, “বাজার হচ্ছে একটি পণ্য বা সেবার বর্তমান ও সম্ভাব্য সকল ক্রেতার সেট।”

  • Lamb, Hair এবং McDaniel এর মতে, “বাজার হচ্ছে প্রয়োজন বা অভাব এবং ক্রয়ের যোগ্যতা ইচ্ছাযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন।”

  • Henry Assael এর ভাষায়, “বাজার হচ্ছে একদল ক্রেতা যারা একই পণ্য সুবিধা প্রত্যাশা করে।”

  • বাজারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Stanton, Etzel এবং Walker বলেন, “বাজার বলতে বুঝায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদের মেটানোর মতো অভাব আছে, ব্যয় করার মতো অর্থ আছে এবং অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা আছে।”

  • Boone এবং Kurtz এর ভাষায় বাজার হচ্ছে ক্রেতা যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে এবং ক্রয়ের ইচ্ছা ও কর্তৃত্ব উভয়ই আছে।

সবশেষে 

অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বাজার কয় প্রকার হয়ে থাকে।  ক্রেতা, বিক্রেতা ও ভোক্তার উপর বাজারের প্রকারভেদ নির্ভর করে। আজকের আর্টিকেলে আমরা বাজার কত প্রকার ও কি কি সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি থেকে আপনি কিছুটা হলে উপকৃত হয়েছেন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

আরো জানুনঃ

Leave a Comment